টিটো

সিজন ওয়ান

আলাদা আলাদা অর্থ সামাজিক পটভূমি থেকে উঠে আসা তিনজন খুনের আসামি, বয়স প্রত্যেকেরই কাছাকাছি, কিন্তু খুনের কারণ…? সে কথায় একটু পরে আসছি, আর এই তিন খুনের আসামির সঙ্গে একজন মহিলা সোশিয়লজিস্টের লাগাতার ইন্টারঅ্যাকশন। এই অব্দি পড়েই নাগেশ কুকুনুরের তিন দিওয়ারে ছবির কথা মনে পড়তে বাধ্য, তবে হ্যাঁ, ওই শুধুমাত্র মনে পড়া অবধিই, তারপর কাহিনী গড়িয়েছে সম্পূর্ণ অন্য খাতে, অন্য স্রোতে, অন্য অভিমুখে। হ্যাঁ,হইচইয়ের থ্রিলার সিরিজ, “বন্য প্রেমের গল্প, সিজন ওয়ান” এর কথাই হচ্ছে।

ইদানিং বেশকিছু ক্রাইম সিরিজ এবং অরিজিনাল ফিল্মে ঘনঘোর রহস্যের মেঘ ঘনিয়ে তোলার পরই কোনো না কোনো বাইপোলার ডিসঅর্ডার, মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার ইত্যাদি ইত্যাদির মত মানসিক সমস্যার ঝোড়ো হাওয়া বইয়ে হঠাৎ আকাশ সাফ করা জলবৎ তরলং সমাধান দেখে দেখে কিছুটা হাঁপিয়েই উঠেছিলাম। সত্যি বলতে কী, নামেই একটি বিখ্যাত বাংলা ছবির সঙ্গে রিদমিক সিমিলারিটি খুঁজে পেয়ে তার ওপর ইঙ্গিতপূর্ণ “বন্য” শব্দটির টানেই খুব ক্যাজুয়ালি এই সিরিজ দেখতে শুরু করে কখন যে তিনটে এপিসোড শেষ করে ফেলেছিলাম নিজেও বুঝতে পারিনি। কারণ, আঁটোসাঁটো প্লট, কিছু রক্ত মাংসের চরিত্র, টানটান চিত্রনাট্য, আর তার সঙ্গে মানানসই অভিনয়। তিনটি খুন,প্রত্যেকটাই যাকে বলে ঐ ক্রাইম অফ প্যাশন। কখনো একতরফা প্রেমের বন্য আবেগে ভেসে, কখনো প্রেমকে পরিণতি দেওয়ার তাগিদে তো কখনো আবার রিপুর প্রবল তাড়ণায় গৌরব, কানাই আর শফিকুলের জায়গা হয় সংশোধনাগারে আর সেখানেই নিজের থিসিসের জন্য রিসার্চ করতে বিস্তর কাঠ খড় পুড়িয়ে হাজির হয় মৃণালিনী(তনুশ্রী)। যদিও গল্প শুরু হয় আরো বেশ কিছুটা পর থেকে, যখন গৌরভ, কানাই আর শফিকুল জেল ভেঙ্গে পালায় আর মৃণালিনীর জন্য রেখে যায় ইংরেজিতে লেখা একটি আদিরসাত্মক প্রেমপত্র। যা নিয়ে মৃণালিনী তো বটেই তার সঙ্গে যথেষ্ট বিব্রত মৃণালিনীর পুরুষ বন্ধু জয় (গৌরব চ্যাটার্জী) ও হট শট পুলিশ বন্ধু সুব্রত (সাহেব ভট্টাচার্য্য)। কে ওই চিঠি লিখেছিল মৃণালিনীকে? কেন? জেল পালানো কয়েদিদের কি হলো? আবার কি শুরু হলো আরো একটি ক্রাইম অফ প্যাশনের কাহিনী? উত্তর মেলে না ।

এরপর ক্রমশ জল গড়াতে থাকে জালও ছড়াতে থাকে। গৌরব শফিকুল আর কানাই এর অতীত ফুটে ওঠে একটু একটু করে, স্পষ্ট হতে থাকে তাদের অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার কাহিনী। পাশাপাশি কাহিনী জমে ওঠে মৃণালিনী, সুব্রত আর জয়ের ত্রিকোণ রসায়ন কে কেন্দ্র করে,আর পালিয়ে যাওয়া অপরাধীদের খোঁজ? সে তো চলছেই। আর রিভিউর ঠিক এই জায়গাতেই প্রয়োজন বাড়তি সাবধানতা, একেতো গোটা সিরিজ ঘিরে একাধিক প্রশ্ন আর যেকোন একটার উত্তরেই টাল খেয়ে যেতে পারে এই অতি যত্নে গড়ে তোলা সাসপেন্সের ঘেরাটোপ। হ্যাঁ, সার্থক থ্রিলার কাহিনীর মতোই সিরিজ শেষে প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর এসে দাঁড়ায় একে অপরের হাত ধরে এবং বেশিরভাগ উত্তর খুঁজে পাওয়ার পরই আপনার যখন বেশ “সব বুঝে ফেলেছি” টাইপ একটা আমেজ আসবে তখনই শেষ এপিসোডে আপনাকে পুরোপুরি নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য রয়েছে এক তুমুল ধাক্কা, যেখান থেকে প্রায় ওয়ান এইট্টি ডিগ্রি…..ব্যাস্, এইটুকুই এর বেশি বললে স্পয়েলার হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রায় নব্বই শতাংশ তাই এবার নজর ফেরানো যাক অভিনয়ের দিকে।

প্রথম ছবি “বেডরুম” থেকেই তনুশ্রীর ধারালো অভিনয়ে অনুরাগী বাংলা ছবির দর্শক। প্রায় এক দশকের মাথায় মৃণালিনীর চরিত্রে তিনি আরো সংযত আরো অনুভবি। স্বাধীনচেতা একাডেমিক মৃণালিনীর পার্সোনালিটি, ম্যাচিউরিটি, আত্মমগ্নতা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। অল্প সময়ের জন্য হলেও বেশ ভালো লাগে গৌরব চ্যাটার্জীর উপস্থিতি, একজন ইউনিভার্সিটির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের ব্যক্তিত্ব আর মৃণালিনীর ইনসিকিওর্ড প্রেমিকের দ্বন্ধে রীতিমতো রক্তমাংসের একটি চরিত্র তৈরি করেছেন তিনি। গোটা সিরিজে তনুশ্রীর পাশে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে অভিনয় করে গেছেন সাহেব ভট্টাচার্য কিন্তু একজন ইয়ং ড্যাশিং পুশিং কপের চরিত্রের জন্য যে চটপটে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রয়োজন কোথাও কোথাও তার খামতি কিন্তু চোখে পড়েছে। এনা সাহা নিঃসন্দেহে এই সিরিজের একজন আবিষ্কার, একটা সারপ্রাইজ। তিন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র যাদের অস্তিত্ব শুধুমাত্র ওই তিনজন অপরাধীদের স্মৃতিতে তাদের ব্যাক স্টোরিতে। মূল কাহিনীতে সরাসরি প্রভাব না ফেলা এই তিনটি চরিত্রেই এনা সাহার কাস্টিং এর সিদ্ধান্তের জন্য পরিচালকের রীতিমতো বাহবা প্রাপ্য, আর এই তিনটি চরিত্রেই এরপর ছয় মেরেছেন এনা। এখনো বাংলা ইন্ডাস্ট্রি এই অভিনেত্রীকে সে ভাবে ব্যবহার করতে পারলো না এটা সত্যিই আক্ষেপের। পরিচালকের আরো একদফা প্রশংসা প্রাপ্য এই সিরিজের ঘনিষ্ঠ দৃশ্যগুলোর গড়ে তোলার মুন্সিয়ানার জন্য, এইসব দৃশ্যে আবেগের তীব্রতা রয়েছে, রয়েছে পেয়ালা উপচে পড়া উত্তেজনাও কিন্তু খুব সাবধানে অশ্লীলতা এবং রঙিন আলোয় স্লো মোশানে লার্জার দ্যান লাইফ অতিনাটকীয়তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কানাই ,গৌরব ও শফিকুল এই তিন চরিত্রের অভিনেতারা এতটাই সাবলীল যে একবারের জন্যও তাদের চরিত্র থেকে আলাদা করা যায়নি।

এতকিছুর মধ্যেও খুঁত কি নেই? অবশ্যই আছে, যেমন ফ্ল্যাশব্যাক মানেই ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট, এই ধারনার বাইরে বেরিয়ে যদি ওই ট্র্যক গুলির প্রধান চরিত্রের আবেগ ও অনুভূতির উপর ভিত্তি করে আলাদা আলাদা কালার টোন সেট করা যেত বা ক্লাইম্যাক্সে মৃণালিনী সুদীর্ঘ সংলাপকে যদি ভিজুয়াল সাপোর্টের সঙ্গে ধরা হতো তাহলে জাস্ট জমে যেত। আবার যেমন মৃণালিনীর মা শতাব্দীও কুন্তলদার প্রেমের ট্র্যাকটির প্রয়োজনীয়তা ঠিক চোখে পরলো না গোটা সিরিজে। এই সম্পর্কটিকে বেশ আরোপিত লেগেছে তবে দ্বিতীয় সিজনে এই সম্পর্ক নতুন কোন রং নিয়ে ধরা দিতেই পারে। সবশেষে সিজন টু ইতিমধ্যেই এসে গেছে কিন্তু ইচ্ছে করেই দেখিনি। কারণ, এখনো কিছু পর্বের স্ট্রিমিং বাকি আছে শুনেছি..